জেন-জেডের বিপ্লব

লেখক : ইকবাল আহমেদ
প্রকাশনী : স্বরবর্ণ প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ৮০
সংস্করণ : ১ম প্রকাশ, ২০২৫
ভাষা : বাংলা
আইএসবিএন : ৯৭৮৯৮৪৩৫৭১৬৫৬


‘গুলি করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটাই হলো স্যার সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়।’

ওরাই জেন-জেড। দু’হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দিয়েছিল পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে। শহরে টহলদার পুলিশের বন্দুকের সীসা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ঝাঁঝড়া করে দিয়েছিল তাদের বুক। ওরা পালায়নি। বুক পেতে দিয়েছে, ফুটো করে দিয়েছে কলিজা। যেন বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়।

ওরা ছিল ঝঞ্চার মতো উদ্দাম, ঝর্ণার মতো চঞ্চল, বিধাতার মতো নির্ভয়। একেকজন তরুণের বুকে বিপ্লবের আগুন এমনভাবে দাউ দাউ করে জ্বলছিল, যা শেষমেশ স্বৈরাচার হাসিনার অবৈধ ক্ষমতার মসনদ পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলেছিল। দেশপ্রেম যে কিরকম একটা মারাত্মক নেশার রুপ ধারণ করতে পারে, সেটা ওরা রীতিমতো প্রমাণ করে দিয়েছিল। পাবজি, ফ্রি-ফায়ারে ডুবে থাকা গোটা একটা তরুণ প্রজন্ম হঠাৎ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। ফেসবুক বানিয়ে ফেলেছিল ওরা একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিত ফেসবুক স্ক্রল করে করে, দেশের কোথায় কি হচ্ছে, শুধু এসব খবর রাখার জন্য।

দলে দলে রাজপথে নেমে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ, ‘আসছে ফাল্গুনে কিন্তু আমরা দ্বিগুণ হবো।’ তারা আর ধৈর্য্য ধরল না, ফাল্গুনের অপেক্ষা করল না; ফাল্গুন আসার আগেই বহুগুনে ফিরে এলো। বন্দুকের নল উপেক্ষা করে দৌড়ে দৌড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল মিছিল নিয়ে। মিছিলে যাওয়ার সময় মায়ের কাছে ছেলের আবদার, ‘মা, আমি যদি শহীদ হই, আমার লাশ রাজপথ থেকে সরাবেনা, যতক্ষন না বিজয় আসে।’

যখন দেশজুড়ে শুধুই অন্ধকার, তখন সেই সাহসী অরুণ প্রাতের তরুণ দল এলো হাতে মশাল নিয়ে। একজন নয়, দুইজন নয়, এলো লাখে লাখে, কোটিতে কোটিতে। এসে বললো,

‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।’

‘তুমি কে, আমি কে?

রাজাকার, রাজাকার।

কে বলেছে কে বলেছে?

স্বৈরাচার,স্বৈরাচার।’

সাড়ে পনেরো বছর অবৈধভাবে ক্ষমতার মসনদে বসে থাকলেও এর আগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কারো সাহস হয়নি ‘স্বৈরাচার’ শব্দটা উচ্চারণ করার। ফলে তাদের উপর নেমে আসে ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা, ভ্যানে করে লাশের স্তুপ নিয়ে পুড়ে ফেলা হলো আগুনে। এতো গণহত্যা, এতো রক্তক্ষয়ী লড়াই, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আর কেউ কখনো দেখেনি।

ওরা ৯ দফাকে টেনে নিয়ে গেলো ১ দফায়। ১ দফা মানে স্বৈরাচার হাসিনার পতন।

‘বীরাঙ্গনা’ মেয়েরা এলো রাস্তায় রাস্তায়। এসে বললো, আমরা নারী, কোটা চাইনা। আমার ভাইয়ের রক্তের বদলা চাই। আধোঁ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের তালা ভেঙে নারীরা এলো রাজপথে। হোস্টেলের হাড়ি-পাতিলে ঝনঝনিয়ে বাজনা বেজে উঠেছিলো,

‘তুমি কে, আমি কে?

রাজাকার, রাজাকার’ ধ্বনি।

তারা দলে দলে এসে স্লোগান দিলো,

‘দিয়েছি তো রক্ত,

আরো দেবো রক্ত।

রক্তের বন্যায়,

ভেসে যাবে অন্যায়।

দালালী না রাজপথ?

রাজপথ, রাজপথ।’

‘একজনকে মারতে কয়টা গুলি লাগে স্যার?’ একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করে জানতে চান। কোটা আন্দোলনে তার ছেলেও মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে ছেলের লাশ সনাক্ত করে, লাশের সামনে বসে আহাজারি করছেন নিহতের বাবা।

‘স্যার আমার ছেলেটা মারা গেছে। বুলেটে ওর বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। স্যার, আমার ছেলে আর নাই স্যার।’

এইভাবে হাজার হাজার বাবা-মায়ের কোল খালি করে দিয়েছিলো ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে স্বজনদের লাইন। ওরা লাশের খোঁজে এসেছে।

রিকশাচালক আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে যায় মেডিকেলে। রিকশার হুড ধরে চিত হয়ে আছে গুলি খাওয়া শিক্ষার্থী। পশুরা হাসপাতালেও নিতে বাধা দেয়। রিকশাচালক লাশ নিয়ে ঘুরে সারা শহর।

Sorry, the comment form is closed at this time.